পা নেই, হাল ধরেছেন মনের জোরে
বিনোদন ডেক্স
আপলোড সময় :
১৪-০১-২০২৫ ০৬:০০:৫১ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
১৪-০১-২০২৫ ০৬:০০:৫১ অপরাহ্ন
ফাইল ছবি
স্বরূপকাঠির সুটিয়াকাঠি ইউনিয়নের উত্তর কৌরিখাড়া এলাকায় বাড়ি মজনু মিয়ার। তিন ভাইবোনের মধ্যে মেজো তিনি। বাবা ছিলেন চায়ের দোকানি। অভাবের কারণে স্কুলের গণ্ডি মাড়াতে পারেননি।
মাত্র সাত বছর বয়সে এলাকার বিসিক শিল্প নগরীর একটি কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ জোটে মজনুর। সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল।
প্রায় ২৬ বছর আগের কথা। মজনু তখন ২৫ বছরের তরুণ।
কাজ করতে গিয়ে একদিন ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে গুঁতো খেলেন। আঘাত পেয়েছিলেন ভালোভাবেই, কিন্তু খুব একটা পাত্তা দেননি। ভেবেছিলেন, কয়েক দিন পর সেরে যাবে।
বিধিবাম! সেই আঘাতই কাল হয়ে দেখা দেয় তাঁর জীবনে।
পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়। চিকিৎসকরা প্রথমে তাঁর ডান পায়ের আক্রান্ত আঙুলটি কেটে ফেলেন। পরে দুই পায়ের সব আঙুল। পেটেও একটি অপারেশন করতে হয়েছিল প্রথমবার, কিন্তু এতেও ক্ষত সারেনি। পরে একে একে চারবার যেতে হয়েছে ছুরি-কাঁচির নিচে, তাতেও নিস্তার মেলেনি।
এক পর্যায়ে জীবন বাঁচাতে মজনুর দুটি পা কোমরের নিচ থেকে কেটে ফেলেন ঢাকার চিকিৎসকরা! আপাতদৃষ্টিতে কয়েক বছরের দুর্বিষহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মেলে তাঁর। কিন্তু তিনি পড়ে যান আরো কঠিন যন্ত্রণায়। দীর্ঘদিন থাকতে হয়েছিল হাসপাতালে। লম্বা সময়ের চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে মজনুর পরিবারের পথে বসার দশা হয়। পা নেই। ঘরে খাবারও নেই। তাই বসে থাকারও উপায় ছিল না তাঁর। হাতে ভর দিয়েই মজনু বেরিয়ে পড়লেন কাজের সন্ধানে, কিন্তু শারীরিক অবস্থা দেখে তাঁকে কেউ কাজে নিতে চাইত না। এমতাবস্থায় জীবন বাঁচানোর তাগিদে সাধারণত লোকে হাত পাতে, কিন্তু মজনু মনে মনে ঠিক করলেন, যত কষ্টই হোক, কারো কাছে হাত পাতবেন না। ব্যবসা করবেন। আর সে লক্ষ্যে তিনি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে একটি ছোট্ট কারখানা খুললেন।
ক্রিকেট স্টাম্প, ব্যাটের হাতল, খিল, দা, কোদালের হাতল ইত্যাদি বানাতে শুরু করলেন। শুরুতে বেচাকেনা খুব একটা জমত না। কাজের গুণগত মানের কারণে ধীরে ধীরে তাঁর পণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকে। বিশেষ করে কৃষি পণ্যের হাতিয়ার, যেমন—কোদাল, কাস্তে, দা, খন্তা, কুড়াল, হাতুড়ির হাতল ইত্যাদি। এখন তো তাঁর কারখানায় তৈরি করা পণ্য ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে যাচ্ছে।
উপজেলা সদর থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে কৌরিখাড়া বিসিক শিল্প নগরীর পাশে মজনু মিয়ার কারখানা। দেড় শতাংশ জমির ওপর গড়েছেন। উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নের ডুবি বাজার থেকে গোলকাঠ কিনে মিয়ারহাট বাজারে চেরাই করেন। সেই কাঠ দিয়েই তৈরি করেন নানা পণ্য।
শুরুর দিকে কারখানায় সহযোগিতা করতেন তাঁর মা রাবেয়া বেগম, স্ত্রী মিনারা বেগম ও ছোট ভাই মেহেদী হাসান। এখন মজনুর অধীনে কাজ করেন পাঁচজন শ্রমিক। বেতন-ভাতা বাবদ তাঁদের পেছনে লাখখানেক টাকা খরচ হয়। স্থানীয়ভাবে বানানো একটি যান্ত্রিক হুইলচেয়ারে চড়ে বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করে ব্যবসার কাজ চালাচ্ছেন।
তিনি দুই সন্তানের জনক। বড় মেয়ে মরিয়ম আক্তার পড়ছেন স্নাতকে। ছেলেটি কলেজে।
মজনুর মা রাবেয়া বেগম বলেন, 'ওর চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। না খেয়েও কাটাতে হয়েছে বহুদিন। একটা সময় সবাই বলত, ওকে বাঁচানো যাবে না।'
স্থানীয় ইউপি সদস্য খাজা ফরিদ বেপারী বলেন, 'মজনুর জায়গায় অন্য কেউ হলে ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নিত, কিন্তু সে হাত পাতেনি। এটা আমাদের জন্য গর্বের।'
মজনু মিয়া বলেন, 'চেয়েছি যত কষ্টই হোক, আমাকে যেন কারো কাছে হাত পাততে না হয়। এখন কারখানার আয় থেকে কিস্তি দিতে গিয়ে লাভের বড় একটা অংশ চলে যাচ্ছে। কারখানাটা আরো বড় করতে চাই।'
তবে জায়গা এবং পুঁজির অভাবে তা পারছেন না। তিনি বলেন, 'আমার শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণে কেউ মোটা অঙ্কের ঋণ দিতে চায় না। সরকার যদি সহজ শর্তে বিনা সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে এখানে আরো অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারব।'
নিউজটি আপডেট করেছেন : Banglar Jamin
কমেন্ট বক্স